নাটকের মানুষ সৈয়দ দুলাল এর জন্মদিন আজ
এই শহরে নাটক ও সংস্কৃতির অন্ত:প্রাণ মানুষ হিসেবে পরিচিত সৈয়দ দুলাল এর আজ জন্মদিন। বাঙালী সংস্কৃতি চর্চার প্রতি নিষ্ঠাবান এই মানুষটি শুধু বরিশালেই নয়, দেশ-বিদেশেও তিনি আলোচিত। বিশেষ করে দেশে স্টুডিও থিয়েটারের প্রবর্তক হিসেবে তার খ্যাতি এখন দেশ-ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়েছে। তার প্রবর্তিত শব্দাবলী স্টুডিও থিয়েটারের নিয়মিত নাট্য প্রদর্শনী এবং চর্চা এখানকার বিনোদনপ্রিয় স্স্থু দর্শকদের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। আপাদমস্তক নাটক পাগল এই মানুষটির জন্ম হয়েছে ১৯৫৩ সালের ৩ জুলাই এই দিনে। জন্মস্থান বরিশাল নগরীর নবগ্রাম রোড মিরা বাড়ি। সদা হাস্যোজ্জল মিষ্টভাষী সৈয়দ দুলাল’র ৬৪ বছরে স্কুল জীবন থেকে আজ পর্যন্ত তার বিগত দিনে মানুষের ভালবাসায় কেবল বরিশালই নয় রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের বাইরে ইউরোপসহ একাধিক দেশে বরিশাল তথা দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরেছেন নাটক থিয়েটারের মাধ্যমে। সৈয়দ দুলাল শৈশব ও কৈশোরে পিতা সৈয়দ আলতাফ হোসেনের অভিনয় দেখেই নাটকের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন সৌখিন নাট্যকর্মী। এরপরে বরিশালে নাটকের প্রাণপুরুষ প্রয়াত আকবর হোসেনের সংস্পর্শে এসে তৎকালীন সময়ে গড়ে ওঠা বরিশালে গ্রুপ থিয়েটার চর্চার প্রথম সংগঠন খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটারে কাজ শুরু করেন। বরিশালে দর্শনীর বিনিময়ে মঞ্চায়িত প্রথম নাটকে অভিনেতা ছিলেন তিনি।পরবর্তীতে শব্দাবলীর প্রতিষ্ঠালগ্নে বন্ধু শাহনেওয়াজ ও মরহুম হুমায়ুন কবীর সেলিমের উৎসাহে শব্দাবলীতে যোগ দেন। খুব সল্প সময়ের মধ্যেই এ অঙ্গণের সকলের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন। কিছুদিনের মধ্যে শব্দাবলীর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বেশ কয়েক বছর কাজ করার পর নিজের রুটি রুজির প্রয়োজনে বিদেশে চলে যান। বিদেশে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান আয়োজিত নির্দেশনা বিষয়ক কর্মশালায় অংশ নেন। সেই কর্মশালায় তিনি ধারণা পান স্টুডিও থিয়েটারের। এরপর তিনি দেশে ফিরে এসে ১৯৯১ সালের ৩১ ডিসেম্বর ‘মেষ ও রাক্ষস’ নাটকের মঞ্চায়নের মধ্যদিয়ে শব্দাবলীতে স্টুডিও থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। এ ক্ষেত্রে বলতে হয় সৈয়দ দুলাল বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ স্টুডিও থিয়েটারের প্রবর্তকের আসনটি অর্জন করেছেন। শব্দাবলীতে তিনি সবচেয়ে বেশী সময় ধরে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বরিশালে শিশুদের নিয়ে নাটকের কাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন শব্দাবলী’র শিশু থিয়েটার।
বরিশালের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প ও সংস্কৃতির পটরেখায় মাসিক আনন্দ লিখন পত্রিকার সম্পাদনা করছেন। এর আগে বরিশালের অন্যতম আঞ্চলিক দৈনিক পরিবর্তন পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। সহধর্মিনী রেহানা সৈয়দ রুনু। ছেলে সৈয়দ শুভ এবং মেয়ে ইপশিতা নীতি এই নিয়ে বটতলা মীরা বাড়িতে পৈতৃক ভিটায় তাঁর সংসার। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে সৈয়দ দুলাল পরিবারের সবার বড়। সৈয়দ দুলালের জন্ম ১৯৫৩ সালের ৩ জুলাই। শিক্ষাজীবন শুরু করেন নব আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৬৯ সালে বরিশাল এ কে স্কুল থেকে এস এস সি, ১৯৭২ সালে সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ থেকে এইচ এস সি এবং ১৯৭৬ সালে ডিগ্রি পাস করেন।
সৈয়দ দুলাল শব্দাবলীর বাইরে বরিশাল সাংস্কৃতিক অংগনের সার্বজনীন সংগঠন বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদে দীর্ঘ ১১ বছর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর কর্ম তৎপরতায় সাংস্কৃতিক অঙ্গণের সার্বিক সচলতা বৃদ্ধি পায়। ১৯৯৩ সালে বরিশালে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সৈয়দ দুলাল এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। প্রথমে আহবায়ক পরে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০২ পর্যন্ত এবং বর্তমানে নির্বাহী কমিটির সভাপতি মন্ডলীর সদস্য। আন্তর্জাতিক নাট্যসংস্থা ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট (আই.টি.আই) বাংলাদেশ কেন্দ্রের নির্বাহী সদস্য এবং বর্তমানে মনোড্রামা কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। সৈয়দ দুলাল এ যাবৎ চারবার আন্তর্জাতিক নাট্য সেমিনারে যোগ দেন। ২০০০ সালে আইটিআই-এর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ফ্রান্সে দেশ বরেণ্য নাট্য ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ও রামেন্দু মজুমদারের সাথে যোগদেন এবং ইটালী, জার্মানীসহ ইউরোপ মহাদেশের বেশ কয়েকটি দেশের নাট্যোৎসবে যোগ দেন। ২০১৪ সালে আর্ন্তজাতিক নাট্য সম্মেলন আর্মেনিয়ায় যোগ দেন।
নাটকে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০০৩ সালে ঢাকা নান্দনিক তাকে অজিত চট্টোপাধ্যায় পদকে ভূষিত করে। নাটকে বিশেষ অবদানের জন্য ঢাকা পদাতিক প্রবর্তিত আবুল কাসেম দুলাল পদক লাভ করেন। এছাড়া প্রজন্ম নাট্যকেন্দ্র প্রবর্তিত দেবেন্দ্র পদক, অমৃত একাডেমি প্রবর্তিত দানবীর অমৃত পদক, সামাজিক প্রতিষ্ঠান সকাল-সন্ধ্যা পদক, ব্রজমোহন থিয়েটার প্রবর্তিত অশ্বিনী পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী প্রবর্তিত সম্মাননা-২০১৩ ও ২০১৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার নাট্যপদক লাভ করেন।
তাঁর লিখিত নাটক গুলোর মধ্যে ‘‘জীবন্ত পোষ্টার’’ ও ‘‘একাত্তর এবং ইত্যাদি’’ উল্লেখযোগ্য। তার নির্দেশনায় প্রযোজিত নাটকের সংখ্যাও অনেক। চর্যাপদের উপর লেখা সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ নাটক নির্দেশনা দিয়ে বিপুল প্রশংসা অর্জন করেছেন। তাঁর অসংখ্য অভিনীত নাটকের মধ্যে মেষ ও রাক্ষস, বাজলো রাজার বারোটা, একজন নাবিক ও একটি শঙ্খচিল, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় উল্লেখযোগ্য। শিশুদের টেলিভিশন অনুষ্ঠান সিসিমপুর এ গুণী ময়রার চরিত্রে অভিনয় করে তিনি শিশুদের প্রিয় মানুষে পরিণত হয়েছেন।
সৈয়দ দুলালের সংস্কৃতিচর্চা প্রশংসার দাবী রাখে। সাংস্কৃতিক অংগনের যেকোন আন্দোলন সংগ্রামে তাঁর মুখ্য ভূমিকা সকলকে অনুপ্রাণিত করে। এছাড়া যেকোন সাংস্কৃতিক কর্মীর বিপদে, দুঃখ দুদর্শায় তাঁকে পাওয়া যায় আপনজন ও অভিভাবকের মতো। দীর্ঘ হোক তাঁর পথচলা।